সুন্দরবনের বুকে দুবলার চড় : ইতিহাস, জীবন ও সংগ্রামের গল্প
20 December 2025 01:02 am
|
Benadick Falia Shaown
|
Eco-Tourism Sundarban

সুন্দরবনের বুকে দুবলার চড় : ইতিহাস, জীবন ও সংগ্রামের গল্প

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে বিস্তৃত বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের কোলে জেগে ওঠা এক অনন্য ভূখণ্ডের নাম দুবলার চড়। বঙ্গোপসাগরের নোনা জল, পশুর নদী এবং শিবসা নদীর মোহনায় ও তার শাখা-প্রশাখার বুকে জেগে ওঠা এই চড় শুধু একটি ভৌগোলিক স্থান নয়—এটি জেলেদের জীবনসংগ্রাম, প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই এবং শত বছরের লোকজ ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল।
দুবলার চড়ের সৃষ্টি ও ভৌগোলিক ইতিহাসঃ

দুবলার চড় মূলত একটি নদী ও সমুদ্রবাহিত পলিমাটি দিয়ে গঠিত চর। সুন্দরবনের দক্ষিণাংশে পশুর নদী ও শিবসা নদীর মোহনায় ক্রমাগত পলি জমে ধীরে ধীরে এই চড়ের সৃষ্টি হয়। ইতিহাসবিদ ও বন বিভাগ সূত্র অনুযায়ী, এটি প্রাকৃতিকভাবেই গড়ে ওঠা একটি দ্বীপসদৃশ ভূমি, যা সময়ে সময়ে ভাঙন ও জোয়ার-ভাটার প্রভাবে আকার পরিবর্তন করেছে। আজকের দুবলার চড় স্থায়ী জনবসতির জন্য উপযোগী নয়, তবে মৌসুমি বসবাস ও কর্মক্ষেত্র হিসেবে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
দুবলার চড়ে কী কী কাজ হয়ঃ

দুবলার চড় মূলত মৎস্য আহরণ ও শুঁটকি মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য বিখ্যাত। প্রতি বছর শীত মৌসুমে (সাধারণত অক্টোবর থেকে মার্চ) দেশের বিভিন্ন অঞ্চল—বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, খুলনা ও চট্টগ্রাম থেকে হাজার হাজার জেলে এখানে আসেন।
এখানে প্রধানত যেসব কাজ হয়—

ইলিশ, লইট্টা, ফাইসা, চিংড়ি ও অন্যান্য সামুদ্রিক মাছ ধরা

মাছ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি

মাছ বাছাই, লবণ দেওয়া ও রোদে শুকানো

অস্থায়ী কুঁড়েঘর তৈরি ও নৌকা মেরামত,

নিউ-মার্কেট নামে একটি অস্থায়ী বাজারে নানা ধরনের জেলেদের জীবনযাপন এর প্রোয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা-বেচা করা।
জেলেদের জীবনযাপন ও সংগ্রাম

দুবলার চড়ের জেলেদের জীবন অত্যন্ত কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ। তারা সাধারণত বাঁশ, সুন্দরবনের গাছ, সুন্দরবনের গোলপাতা, সোন, পলিথিন ও ত্রিপল দিয়ে তৈরি অস্থায়ী ঘরে বসবাস করেন। বিশুদ্ধ পানির সংকট এখানে নিত্যদিনের সমস্যা, বালি মাটি খুড়ে কুয়া তৈরি করে সেখান থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করে। খাবার রান্না হয় নোনা পরিবেশে, সীমিত উপকরণে।
জেলেদের প্রধান কষ্টগুলো হলো—

প্রাকৃতিক দুর্যোগ: হঠাৎ ঝড়, জলোচ্ছ্বাস

বন্যপ্রাণীর হুমকি: বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও কুমির

দস্যু ও চাঁদাবাজি (আগে বেশি ছিল, এখন তুলনামূলক কম)

বন বিভাগের অনুমতি ও কর সংক্রান্ত জটিলতা

মহাজনের দাদন পদ্ধতির জন্য জেলেদের কষ্টের শেষটুকুও হারানো।

অনেক জেলে দিনের পর দিন গভীর সমুদ্রে জাল ফেলে থাকেন। কখনো জাল ছিঁড়ে যায়, কখনো মাছ মেলে না—তবুও পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার তাগিদে তারা আবার নোনা জলে নামেন।
আলোর কোলের শুঁটকি পল্লির গল্পঃ

আলোর কোল হলো দুবলার চড়ের সবচেয়ে পরিচিত শুঁটকি পল্লি। এখানে সারি সারি বাঁশের মাচায় মাছ রোদে শুকানো হয়। সূর্যের আলো ও সমুদ্রের বাতাসে শুকানো এই শুঁটকি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন।
এই শুঁটকি পল্লি গড়ে ওঠে মূলত জেলেদের প্রয়োজনে। বছরের পর বছর ধরে এখানে একটি মৌসুমি অর্থনীতি গড়ে উঠেছে—জেলে, শ্রমিক, মহাজন, আড়তদার ও নৌকার মাঝিদের সমন্বয়ে।
দুবলার চড়ের রাস মেলা ও রাস মন্দিরঃ

দুবলার চড়ের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক অধ্যায় হলো রাস মেলা। প্রতি বছর শীতকালে (সাধারণত কার্তিক-পূর্ণিমা বা অগ্রহায়ণে) এখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রাস পূজা ও রাস মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

লোককথা অনুযায়ী, বহু বছর আগে এখানে একটি রাস মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়, যা শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলার স্মৃতিবাহী। এই মেলা উপলক্ষে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাধু, বৈষ্ণব ও তীর্থযাত্রীরা আসতেন। বর্তমানে মেলার জৌলুস কিছুটা কমলেও এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অটুট আছে।
অফিস কেল্লা, মরণ চড় ও অন্যান্য স্থানঃ

অফিস কেল্লা এটি বন বিভাগের একটি প্রশাসনিক স্থাপনার নাম, যেখান থেকে বন ও মৎস্য সংক্রান্ত কার্যক্রম তদারকি করা হয়।
মরণ চড়:

(মরন চড়) নাম থেকেই বোঝা যায়, এটি একটি বিপজ্জনক এলাকা। অতীতে এখানে বহু নৌডুবি, জলোচ্ছ্বাস ও বাঘের আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয়দের বিশ্বাস। (মরন চড় নিয়ে পরবর্তীতে বিষদ আকারে সঠিক গল্প লেখা হবে)।

এছাড়াও আশপাশে রয়েছে বিভিন্ন খাল, চর ও বনভূমি, যা সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে।
উপসংহার

দুবলার চড় শুধু একটি চর নয়—এটি প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থানের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি। এখানে নেই শহরের আরাম, আছে জীবনের জন্য লড়াই। জেলেদের ঘামে, সূর্যের তাপে আর নোনা জলের ঢেউয়ে গড়ে উঠেছে দুবলার চড়ের ইতিহাস।

এই চড় আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির পেছনে কত অজানা মানুষের নীরব ত্যাগ লুকিয়ে আছে, যারা প্রতিদিন জীবন বাজি রেখে সমুদ্রের বুকে নেমে পড়ে।
তথ্য সংগ্রহ ও সংক্ষিপ্ত লেখাঃ
বেনেডিক ফলিয়া শাওন,
পরিচালক,
মেরিয়ান সুন্দরবন ট্যুর এন্ড ট্যাভেল।